বাংলাদেশ: প্রকৃতিগত ভাবে পূজার যে সৌন্দর্য্য, বেচারি ঈদের তা নাই ! – ইশরাত জাহান ঊর্মি:



“আচ্ছা আপনারা নিজেদের সেক্যুলার বলে দাবি করেন, তাহলে বাতাসে পূজো পূজো গন্ধ কেন পান? কীভাবে পান? বাতাসে পূজো পূজো গন্ধ যদি পান, ঈদ নিয়া আপনাদের এতো ইচিং হয় কেন? আপনাদের সেক্যুলারিজম সব হিন্দু বা অন্য ধর্ম নিয়া। মুসলমান ধর্ম নিয়া আপনাদের এতো জ্বলে ক্যান?”
-অনেকের মনের মধ্যে এই প্রশ্ন। এবং এইটা হলো প্রশ্ন করার সবচেয়ে সভ্য ভাষা। অসভ্যগুলো প্রশ্নকর্তারাই বলবেন।

এখন কথা হলো, বাতাসে আসলেই পূজার গন্ধ পাওয়া যায়, তার আমি কী করবো? শরৎকালে কাশফুল এবং শিউলি ফুল ফোটে, জলে পম্পা মানে পদ্ম, শরতকালে আকাশে সাদা-নীল মেঘ ভাসে, শরৎকালে রোদের তেজ ক্রমশ মরে আসে, শরৎকালে গ্রামে ভোরবেলা হিম হিম একটা আমেজ পাওয়া যায় এবং শরৎকালেই পূজা হয়। পূজার সময় ঢাক বাজে, পূজার সময় মাইকে পুরাতনি গান বাজে-সব মিলায়ে একটা আবহ তৈরি হয়, ঈদে তা হয় না, তার আমি কী করবো?

পূজাটা হয় বাংলার ঋতু পঞ্জিকার সাথে মিলিয়ে। আর ঈদ হয় আরেক দেশের ক্যালেন্ডারের চাঁদের সাথে মিলিয়ে, ফলে ঈদ শীতে হতে পারে, ঝাঁ ঝাঁ গ্রীষ্মকালে হতে পারে, ঝুম বর্ষায় হতে পারে, শরতে বা হেমন্তেও হতে পারে। প্রকৃতিগত ভাবে পূজার যে সৌন্দর্য্য-অত্যন্ত ব্যথিতভাবে জানাচ্ছি যে, বেচারি ঈদের তা নাই।

নারী হিসেবেও আমি পূজা উৎসবরে ভালোবাসি। বলাই হয়, সর্বজনীন উৎসব। অন্তত: আমাদের দেশে কোনো পূজা মণ্ডপে আমি নারী বলে ঢুকতে প্রতিবন্ধকতা পাই নাই। শুধু নারী বলে নয়, মুসলমান বলেও কেউ বাধা দ্যায় নাই। পাতপেড়ে প্রসাদ খেতে পারছি। কেউ বলে নাই, ওই যবন তুমি, প্রসাদ তোমার না। বরং বনানী পূজামণ্ডপে মনে পড়ে, দশাসই চেহারার এক দিদি ধমকায়ে প্রসাদ খাইয়েছে।
“এ্যাই মেয়ে, ছাতু মাখাইছি চিনি দিয়া, সকাল সকাল আসছো ডিউটিতে (আমি হয়তো টেলিভিশনের চাকরির ডিউটি করতে, মানে পূজা কাভার করতে গিয়েছি), খাও, ভালো লাগবে।” তারপর আছে নারী-পুরুষ হাতে হাত মিলিয়ে ঢাকের তালে নাচ, আছে সিঁদুরখেলার মতো রং মাখামাখি-আমাদের ধর্মে মানে মুসলমান ধর্মে এরকম সার্বজনিনতা কল্পনা করা যায়?
পুরুষেরা বুকে বুক মিলায় ঈদে, ভ্রাতৃত্ববোধ প্রকাশ করে, কিন্তু নারীদের জন্য সিস্টারহুড (ইংরেজিতে ব্রাদারহুড এর বিপরীত শব্দ সিস্টারহুড, কিন্তু ভ্রাতৃত্ব’র বিপরীত স্ত্রীবাচক বাংলা শব্দ কী?) প্রকাশের তেমন কোনো ছবি তো আমরা কোথাও পাই না! একটা উৎসব যদি নারী-পুরুষ সবার জন্য না হয়, সর্বজনীন না হয়, তাহলে সেই উৎসব নিয়ে আমার ইচিং হবেই-সাফ কথা।

আমি ঠিক জানি না দেশীয় সংস্কৃতির সাথে কোন কোন জায়গায় পূজার মাখামাখি আর ঈদ উৎসবের দূরত্ব, শুধু এইটুকু বুঝতে পারি যে, পহেলা বৈশাখে কেনা লাল-সাদা বা কমলা-সাদা শাড়িটা পূজায় বেশ পরে ফেলা যায়, কিন্তু ঈদে কেনা পাকিস্তানী লম্বা ঝালরের জামাটা পহেলা বৈশাখে বেমানান। জোর করে ঈদরে বাঙালী করা যায় না।

বাঙালী সহ্য করতে না পারা দেশে হিন্দু নিধন চলতেছে। নাসিরনগরের ঘটনার সময় আমার মনে আছে, আমি একদিন নিউজ পড়ছিলাম। এক রিপোর্টারের স্টোরির মধ্যে কাঁসার থালা হাতে লালপেড়ে শাড়ি পরা এক নারী নদী থেকে থালাবাসন ধুয়ে উঠে আসার একটা ছবি দেখে হঠাৎই পুরো দৃশ্যটা আমার কাছে অচেনা লাগলো। মনে হলো এই কাঁসার থালা, এই লালপাড় শাড়ি কোন ছোটবেলায় শুকলা আন্টিদের পুকুরঘাটে দেখতাম, এখন কই? গ্রামে গেলেও এসব চোখে পড়ে না তো!

আমাদের প্রধানমন্ত্রী গতবার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে বলেছিলেন, এদেশ আপনাদেরও, আত্মবিশ্বাসের সাথে বসবাস করুন।” শুনেই আমার মনে হলো, নিজের দেশে আলাদা করে ইমফেসিস দিয়ে আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে কেন? আমাদের মনস্তত্ত্বে তবে কি আমরা ইতিমধ্যেই ঢুকিয়ে ফেলেছি যে, হিন্দুরা ঠিক এদেশের নয়! বিপন্ন! সংখ্যালঘু শব্দটার মধ্যে কেমন যেন একটা লজ্জা আছে, সেই লজ্জা আমরা ধীরে ধীরে আত্মিকরণ করে ফেলতেছি। আজকাল আর ঢাকের শব্দ না, প্রতিমা ভাঙার ছবিতে বা খবরে বুঝতে পারি যে, পূজা আসন্ন।

তো, শেষকথা হলো যে, উৎসব সর্বজনীন না, যে উৎসব নারীর জন্য এমবার্গো দিয়ে রাখে, সেই উৎসব নিয়ে ভুরু কুঁচকালে উল্টোদিকে যে উৎসব আমারে হাতে হাত ধরার স্বাধীনতা দ্যায়, সেই উৎসব নিয়ে আমি গদগদ হলে আপনাদের ভুরু কুঁচকানোরে আমি কেয়ার করি না।
Share on Google Plus
JanaSoftR

0 comments:

Post a Comment